ছফানামাঃ লেখকদের চোখে আহমদ ছফা

Mohammad Anisul Islam
29 min readJul 1, 2021

০১.

“… ছফা সাহেবের সঙ্গে আমার কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না। পরিচয় ঘটে কলকাতায় ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ চলবার সময়। একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল তার সঙ্গে আমার, যার স্মৃতি আজও মনে জাগরুক আছে। আমি ঢাকাবাসী নই। তবে একসময় কয়েক বছর ছিলাম ঢাকায়। ঢাকা থেকে সে সময় ‘সমকাল’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হত। আমি সেই পত্রিকায় লিখতাম। লেখার মাধ্যমে পরিচয় ঘটেছিল সমকাল সম্পাদক সেকেন্দার আবু জাফর-এর সঙ্গে। জাফর সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশ ঘনিষ্ঠই ছিল। তবে আমি ঢাকা ছাড়ি। ঢাকার জগতের সঙ্গে আমার আর পরিচয় থাকে না কোনাে ক্ষেত্রে। ঢাকার লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী — কারাে সাথেই আমার থাকে না কোন পরিচয়।

১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় চলে যাই কলকাতায়। কলকাতা আমার কাছে ছিল অনেক পরিচিত শহর। রাজশাহী শহরে জীবনের যথেষ্ট ঝুঁকি ছিল। সেখানে থাকলে আমি বাঁচতাম না। কলকাতায় গিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘জয়বাংলা’। এই পত্রিকার সঙ্গে পরে গিয়ে যােগ দেন আগাচৌ (আবদুল গাফফার চৌধুরী)। কিন্তু গােড়ার দিকে তিনি ছিলেন না। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি একদিন কবিবন্ধু আল মাহমুদ-এর কাছ থেকে শুনতে পেলাম সেকেন্দার আবু জাফর কলকাতায় এসেছেন। আল মাহমুদ-এর মাধ্যমে তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করি। জানি না, তিনি কেন ঢাকা থেকে কলকাতা যাবার প্রয়ােজনবােধ করেছিলেন। যতদূর জানতাম, সে সময় তার চীনপন্থী বামদের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বিশেষ সখ্য। আর চীনপন্থীদের জীবন বিপন্ন ছিল না ঢাকায়। জাফর সাহেব বললেন, তিনি ‘অভিযান’ নামে একটি সাপ্তাহিক কাগজ বের করার ভার পেয়েছেন খন্দকার মুস্তাক আহাম্মদ-এর পক্ষ থেকে। আমাকে কিছু লিখতে হবে তার সেই পত্রিকায়। আমি রাজি হই। তবে আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে, জাফর সাহেবকে মুস্তাক কেন বেছে নিলেন। সে সময় কলকাতাতেই মুস্তাক ও তাজাউদ্দীনের বিভেদ ছিল চরমে। জাফর সাহেবকে তাজউদ্দীন যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। কলকাতায় তখন সেকেন্দার সাহেবের কবিতার আবৃত্তি হচ্ছে : প্রয়ােজন হলে দেব এক নদী রক্ত।

আমি একদিন জাফর সাহেবের থাকার ঘর এবং ‘অভিযান’ পত্রিকার অফিসে যাই। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আহাম্মদ ছফা। জাফর সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সঙ্গে। ঢাকার একজন তরুণ বুদ্ধিজীবী হিসেবে করলেন তার খ্যাতি। বললেন, খাতা কলমের সম্পাদক যদিও তিনি, তবে কার্যত কাগজটি চালাবেন ছফা সাহেব।

আমি জানতে চাই, কাগজটা কি উদ্দেশ্য নিয়ে বের করছেন তারা। জাফর সাহেব আমাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করাই হবে পত্রিকার উদ্দেশ্য। আমি হঠাৎ বলে ফেলি — “তার কি কোন আর প্রয়োজন হবে। ভারত নিজেই যাচ্ছে যুদ্ধ করতে। আমাদের আর যুদ্ধ করবার প্রয়ােজন হবে না। সম্ভবত, আমরা যুদ্ধ করি ভারত সরকার সেটা চাচ্ছেও না। কারণ যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে তার উপর কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকবে আওয়ামী লীগের, না থাকবে ভারতের। যুদ্ধ নেবে আর এক রূপ। শেষ পর্যন্ত সমগ্র পূর্ব ভারতের ভবিষ্যতকেই তা করে তুলতে পারে অনিশ্চিত। ভারত তাই চাচ্ছে, সরাসরি যুদ্ধ করে এই যুদ্ধের দ্রুত ছেদ টানতে।”

ছফা সাহেব বলেন, আমার ধারণার সবটাই ভুল। আমি তার বিরােধিতা করে বলি, যা বলছি সেটাই ঠিক। আমার কথার উপর নির্ভর করতে পারেন। আমি যা বলছি তা তথ্যভিত্তিক। কোন বিশেষ থিওরি ভিত্তিক নয়। ছফা বললেন, ভারত প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়াতে সাহসই করবে না। আমি বলি, করবে। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে হঠাৎ ছফা সাহেব মারমুখী হয়ে ওঠেন। আর তার সেই কাণ্ড দেখে বিশেষভাবে অপ্রস্তুত হন জাফর সাহেব। আমি সেখান থেকে প্রস্থান করি। অভিযান পত্রিকা কয়েক কপি না বের হতেই ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয় পাক-ভারত যুদ্ধ।

শুনেছি ঢাকায় ফিরে আহমদ ছফা গ্রহণ করেন ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরােধী অবস্থান। আমিও গ্রহণ করি ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরােধী অবস্থান। এদিক থেকে আমরা এসে পড়ি অনেক কাছাকাছি। কিন্তু তার সাথে আবার আমার কখনাে দেখা হােক সেটা চাইনি। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা ইন্তেকাল করলেন। পত্রিকায় আহমদ ছফা সম্বন্ধে অনেকের আলােচনা পড়ে, আমার মনে পড়লাে ১৯৭১-এর স্মৃতি॥”

– এবনে গোলাম সামাদ / বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া ॥ [ মজিদ পাবলিকেশন — মার্চ, ২০০৪ । পৃ: ১৩১-১৩২ ]

০২.

“… একবার আনন্দবাজারের বাদল বসু আমার একটা ইন্টারভিউর প্রতিবাদ করে খুব খারাপ কথা বলেছিলেন। তারপর আমাদের দেশের প্রবীণ লেখক শওকত ওসমান বললেন, আহমদ ছফা খুব খারাপ লোক। উনি (শওকত ওসমান) খুব খারাপ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, সেই শব্দটা আমি বলছি না। এরপর একদিন আমি শওকত ওসমানকে সাথে নিয়ে ঢাকার নিউ মার্কেটে গেলাম। নিউ মার্কেটের সব বইয়ের দোকানে শওকত ওসমানের বই চাইলাম, কিন্তু কোন বইয়ের দোকানই শওকত ওসমানের কোন বই দিতে পারে না। কিন্তু যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই চাইলাম, দেখা গেল মুদির দোকানও তা দিতে পারে। শেষে আমি শওকত ওসমানকে বললাম, সুনীল আপনার বড় না ছোট? তিনি বললেন, ছোট, অনেক ছোট। ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি। আর জানবেন শওকত ওসমান লেখক হিসেবে ছোট লেখক নন, তবে অনেক লেখা আছে উৎকর্ষের বিচারে যা বেশ ভাল। এই অবস্থা দেখে আমি শওকত ওসমানকে বললাম, দেশটা কি আমরা বাল ছেঁড়ার জন্যে স্বাধীন করেছি?”

— আহমদ ছফা / আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারসমগ্র ॥ [ সম্পা: নূরুল আনোয়ার । খান ব্রাদার্স — ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ । পৃ: ২২৫ ]

০৩.

“… বাংলাদেশের কিছু কিছু অধ্যাপক এবং সাহিত্যিকের কথা জানি যারা কোলকাতা গিয়ে রাতারাতি ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্য তাঁদের কোলকাতায় যেয়ে খুন করবে সেরকম কোন সম্ভাবনা ছিল না। তবু তারা ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। এর প্রয়োজনটা কি ছিল? প্রয়োজন ছিল বৈকি। তা দু’ধরণের। এক, তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না যে বাংলাদেশ সত্যি স্বাধীন হবে। যদি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান টিকেই যায় আর তাঁদের যদি দেশে ফিরে আসতে হয়, বলতে পারবেন তাঁরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করেননি। দুই নম্বর হল, ছদ্মনামে সত্যি-মিথ্যে গল্প ফেঁদে ভারতীয় জনগণের সহানুভূতি আকর্ষণ করার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তার সদ্ব্যবহার। যেহেতু ছদ্মনামে লিখেছেন তাই দেশের কেউ তাঁদের কোন কার্যকলাপের প্রতি চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না। যারা এরকম দূর্বলচিত্তের এবং যুদ্ধের সময়ে এই দোদুল্যমানতার পরিচয় দিয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এসে মুক্তি-সংগ্রামী হিসেবে কিভাবে দাপট দেখান এবং সরকার কোন যুক্তিতে তাঁদের টেনে তুলে উঁচু পদে বসালেন? এ ধরণের অপকর্ম শুধু লেখক-সাংবাদিকরা করেছেন এবং অন্যরা একেবারে খাঁটি ছিলেন সে কথা কিছুতেই নয়। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত লোকেরা যা করেছেন ঠিকমত প্রকাশ পেলে লোম দাঁড়িয়ে যাবে, তা প্রকাশ করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। বাংলাদেশ যে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে, আমাদের কোন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কল্পনায় আভাসিত হয়নি। দুই যুগ, এক যুগ, দুই বছর এমনকি এক বছর আগের লেখা কোন বইতে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতে পারবে, তাঁর ছিটেফোঁটা উল্লেখও দেখতে পাচ্ছিনে। বাংলাদেশের জনগণই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। ঘটনা ঘটেছে ঘটনার নিয়মে। বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তার কোন তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া হয়নি। বাংলাদেশের নির্দেশনা ব্যতিরেকেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে একটা কথা আছে না, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের ক্ষেত্রে তা আরো একবার সত্যে পরিণত হয়েছে। সকল ঘটনা ঘটে যাবার পর সকলে আপনাপন গর্ত থেকে শেয়ালের মত বেরিয়ে সমস্বরে জয়ধনি তুলছেন। আগে বুদ্ধিজীবিরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন- সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেক আছে, যারা অন্ধভাবে হলেও ইসলাম, পাকিস্তান ইত্যাদিতে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চতুস্তম্ভের জয়ধনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবি রয়েছেন, যাঁরা সারাজীবন কোনকিছুতে যদি নির্দ্ধিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন — সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ॥”

— আহমদ ছফা / সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ॥ [ খান ব্রাদার্স — ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ । পৃ: ৬১ ]

০৪.

“… লেখক সংঘ মানে লেখকেরা কি ভাববেন, কি চিন্তা করবেন, কি লিখবেন, কিভাবে লিখবেন জঙ্গীলাট নির্দিষ্ট করে দেবেন। তিনি যা বলবেন — এরা তা লিখবেন। বিনিময়ে লেখকদের দেয়া হল অঢেল সুযোগ-সুবিধা। তাদের জন্য আদমজী পুরস্কার, ঘন ঘন বিদেশ যাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন। সেদিন বাংলাদেশে একজন লেখকও লেখকের সুস্থ এবং স্বাধীন মননশীলতার বিরোধী এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিরুদ্ধে টু-শব্দটি করেননি। বরং সকলে বগল বাজিয়ে আপনা থেকেই এগিয়ে এসে অংশগ্রহণ করেছেন। খ্যাতনামা পশ্চিমা দালালদের কথা বলে লাভ নেই। যারা কমিউনিস্ট, সর্বহারার অন্দোলনে বিশ্বাসী বলে পরিচিত ছিলেন, তাদেরও অনেককে দেখা গেছে। ধনপতিদের হাত থেকে অর্থ পুরস্কার গ্রহণ করতে পেরে জীবন ধন্য মনে করেছেন।

চিহ্নিত প্ৰতিক্রিয়াশীলরা তো প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের সহযোগিতা করত। সেটা জানা কথা। কিন্তু তথাকথিত প্ৰগতিশীল এবং কমিউনিস্টদেরও দেখা গেছে কার্যত জঙ্গীলাটের সহায়তা করতে। আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং হাবীব ব্যাংক পুরস্কার যারা গ্ৰহণ করেছেন, সে তালিকাটা আমাদের সামনে খোলা রয়েছে। তাতে এমন ক’জন মানুষের নাম রয়েছে, যাদেরকে এক শ্রেণীর মানুষ দেবতার মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। আজকের বাংলাদেশের যে সকল খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক আছেন, তাদের বেশিরভাগই একভাবে না একভাবে সামরিক সরকারের সহযোগিতা করেছেন। এদের সকলে কি আইয়ুব খানের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেননি? শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এদের কেউ কেউ জীবনপাত করেছেন বলে শোনা যায় — আদমজী, দাউদের দেয়া পুরস্কার গ্রহণ করে কোন শ্রেণীর রাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা তারা কামনা করেছিলেন? তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে সৎ-লেখক ও সৎ-বুদ্ধিজীবী ছিলেন না বললেই চলে। মুখে সর্বহারার রাজনীতি কিন্তু কাজের বেলায় বাঙালি-সংস্কৃতিরও বিরোধিতা করেছেন অনেকে।

বিএনআর-কে দোষ দেয়া হয়ে থাকে — দোষ দেয়া হয় শুধু হাসান জামানকেই। কিন্তু বিএনআর-এ যাননি কোন লেখক? সকলেই টাকা নিয়েছেন — আবার জনগণের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সকলেই বিএনআর-এর গােষ্ঠী উদ্ধার করছেন। চমৎকার রসিকতা। বাংলাদেশের সমস্ত নামকরা কবি-সাহিত্যিক যারা সোনার বাংলা নামে কেঁদে-কুটে বড় বড় পদ দখল করে বসেছেন — তাদের শতকরা নিরানব্বই ভাগই যে অকাণ্ডকুকাণ্ড করেছেন তার ভুরি ভুরি প্রমাণ হাজির করা যায়॥”

— আহমদ ছফা / সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ॥ [ খান ব্রাদার্স — ফেব্রুয়ারি, ২০১১ । পৃ: ৫৭-৫৮ ]

০৫.

“… সেই সময়ে গোটা পাকিস্তানে যে সমস্ত রাজনৈতিক দলের মোটামুটি সংগঠন ছিল এবং পিছনে জনসমর্থন ছিল, সেগুলোর নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) কুৎসা-কীর্তন করতেন। ভারতের চর, নাস্তিক্যবাদের প্রবক্তা এবং পাকিস্তানের সংহতির শত্রু ইত্যাদি অপবিশেষণে চিহ্নিত করতেন। অন্য অনেকের কথা বাদ দিয়ে বাঙালী জনগণের কাছে অধিকতর সুপরিচিত এবং বাঙালী জনগণের অত্যন্ত প্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দীর কথা উল্লেখ করার মতো। ন্যাপ যখন স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নটির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করছিল সেই সময়ে তিনি একাধিকবার বলতে কুন্ঠিত হননি, পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নামে যে রাজনৈতিক সংগঠনটি উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়-দফা আন্দোলনকে ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবীর আন্দোলন জোরদার করেছে, যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের জন্ম, গোড়ার দিকে সেই একই আওয়ামী লীগ দলগতভাবে পাকিস্তানের মসনদে আসীন থাকার সময়ে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর বিরোধীতাই করেছিল॥”

— আহমদ ছফা / বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা ॥ নির্বাচিত প্রবন্ধ॥ [মাওলা ব্রাদার্স — ফেব্রুয়ারি, ২০০২ । পৃ: ১৭০-১৭১]

০৬.

“… একটা কথা বলি, শেখ সাহেব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে ‘জয় বাংলার’ সাথে সাথে ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন। এখন এই ভাষণ নিয়ে নানা বিতর্ক-বিতন্ডা চলছে। আমি ছোট্ট মানুষ। আমাকে সাক্ষ্য দিতে কেউ ডাকবে না। আমি যেমন শুনেছি, তেমনি বললাম। হতে পারে, আমার শ্রুতির বিভ্রম ঘটেছিল॥”

— আহমদ ছফা / বেহাত বিপ্লব : ১৯৭১ । সম্পাদনা : সলিমুল্লাহ খান ॥ [আগামী প্রকাশনী — ডিসেম্বর, ২০১৩ । পৃ: ৮৪]

০৭.

“… ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের ঘটনা বর্ণনা করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষের লোকেরা ব্যাপারগুলোকে এমনভাবে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেন যে, সে সময় বাংলাদেশে একই সঙ্গে দুধ এবং মধুর ধারা প্রবাহিত হত, যেন সে সময় কোন অন্যায়, অবিচার, খুন, জখম, দূর্নীতি এসব হয়নি। আমরা যারা সে সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে বাংলাদেশে একটি সুস্থ এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই করে আসছিলাম, আমাদের যেসব নিষ্ঠুর নিদারুণ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে, সেসব কথা আমরা যদি উচ্চারণ না করি, আমরা শুধু নিজেদের ওপর অবিচার করব না, ইতিহাসের ওপরও অবিচার করব।

আমাদের আসল দু:খের বিষয় হল — এখানে সকলে চর দখল করার মত করে ইতিহাস দখল করার চেষ্টা করছে। ইতিহাসে যে সকলের অধিকার রয়েছে, একথা কেউ মানতে চান না। যে যখন ক্ষমতায়, ইতিহাস তার অধিকারে। বাংলাদেশের ইতিহাস বাংলাদেশের জনগণের নয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অথবা বাংলাদেশ বিএনপির। এখানে ইতিহাসের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয় সমস্ত জনগণের কর্ম-প্রবাহের মধ্যদিয়ে ইতিহাসের চাকা এগিয়ে যায় না। এখানে ইতিহাসের চাকার তলায় জনগণ পিষ্ট হয়॥”

— আহমদ ছফা / উপলক্ষের লেখা ॥ [ খান ব্রাদার্স — ফেব্রুয়ারি, ২০১০ । পৃ: ১৪৫ ]

০৮.

“… এই সময় তাদের লোভ-লালসার প্রবৃত্তি গুটিবসন্তের জীবাণুর মতো ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেতে আরম্ভ করে। অবাঙালিদের ঘরবাড়ি দখল, দোকান-ব্যবসা আত্মসাৎ এবং যে সকল লোক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে তাদের ধন সম্পদ লুটতরাজ করাই আওয়ামী লীগের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের পেশা হয়ে দাঁড়াল। এই কর্মের সঙ্গে কর্মী এবং নেতা এত অধিক হারে জড়িত ছিল যে দলীয় কোনো শৃঙ্খলা প্রয়োগ করে তাঁর (মুজিব) পক্ষে রাশ টেনে ধরা অসম্ভব ছিল। বরং ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক এই পঙ্কিল আবর্তে নিপতিত হয়ে তিনি নিজেও খেই হারিয়ে এই কর্মকান্ডের অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন॥ ”

— আহমদ ছফা / বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা (প্রবন্ধ সমগ্র — ১) ॥ [হাওলাদার প্রকাশনী — জুন, ২০১৪ । পৃ: ২৭৩]

০৯.

“… জওহরলাল নেহেরু মনে প্রাণে আসমুদ্র হিমাচল প্রসারিত একটি বৃহত্তর ভারতের স্বপ্ন দেখতেন এবং এই স্বপ্নকে তিনি ভারতের শাসক নেতৃশ্রেণীর মনে ভালো করে চারিয়ে দিতে পেরেছিলেন। জার্মানদের ফাদারল্যান্ড এবং ইহুদীদের হোলিল্যান্ডের মতো বৃহত্তর ভারতের স্বপ্নও ভারতীয় নেতৃশ্রেণীর মর্মের গভীরে গেঁথে গিয়েছিল। তারা মনে করতেন বৃহত্তর ভারতের স্বপ্ন মিথ্যা হওয়ার নয়, প্রশ্নটা শুধু সময়ের।

… ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে ফলাও করে প্রচার করেছিল ভারতীয় প্রচারমাধ্যম এবং পত্রিকাসমূহ। এই প্রচারণা মধ্যে একটি অবহেলিত অঞ্চলের জনগণ যে সংগ্রাম করে আপন ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন এবং আরও নানা দাবীদাওয়া আদায় করে নিচ্ছেন, তার চাইতে অধিক কিছু ছিল। পাকিস্তানের ভাঙনের বীজটি অঙ্কুরিত হতে দেখে তারা উৎসাহিত হয়েছিলেন। সেই মনোভঙ্গীটুকুও প্র্চারণার সঙ্গে যুক্ত হযেছিল। উলঙ্গ হুঙ্কার এবং হম্বিতম্বির চাইতে ধীরেধীরে সময় বুঝে কাজ করাই ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য।

১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের আক্রমণ মূলত: পশ্চিম রণাঙ্গনেই সীমিত রেখেছিল। আক্রমণকারী হিসেবে উপস্থিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব বিগড়ে যাবে এ আশঙ্কা করেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বলতে গেলে একেবারে অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানে স্থলপথে, জলপথে কিংবা বিমানপথে কোনো আক্রমণ করেনি। কোনরকমের সামরিক হামলা না করে পূর্ব পাকিস্তানের জনমতকে জয় করার ইচ্ছাই ছিল তার মূলে, এ কথা স্ব্য়ং ভারতীয় জেনারেল কাউলও তার আত্মকথায় স্বীকার করেছেন।

১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পরে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পুনরায় সংগঠিত হয় এবং ছয়দফা আন্দোলন জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে যে ছড়িয়ে পড়ে তা নিশ্চয় ভারতীয় শাসকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। ছয়দফার অন্তর্ভুক্ত দফাসমূহের একটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের লোক দিয়ে একটা প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করতে হবে এবং অন্য একটি দফায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সুযোগ-সুবিধা মতো যে কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করার অধিকার। ভারত এই ছয়দফার মধ্যে অভীষ্ট সিদ্ধির পথ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল। পাকিস্তানের দু’অংশ যদি শ্লথভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, ভারতের প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেকাংশে কমে আসবে। পাকিস্তান যখন তখন আর যুদ্ধেব্র হুঙ্কার দিতে পারবে না। আন্তর্জাতিক শক্তিবর্গ সংহত পাকিস্তানকে যেভাবে অস্ত্র সাহায্য করে, অর্থের যোগান দিয়ে ভারতের সমপর্যায়ের একটি শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখত, শিথিল পাকিস্তান বৃহৎ শক্তিবর্গের দৃষ্টিতে সেরকম গুরুত্ব বহন করবে না। পাকিস্তান দূর্বল হয়ে পড়লে তার যুদ্ধংদেহী মনোভাব আপনা থেকেই প্রশমিত হয়ে আসবে। তখন বৃহৎ শক্তিবর্গ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যে ভারত-ঘেঁষা নীতি প্রণয়ন করতে বাধ্য হবে।

ছয়দফার একটা দফায় পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের অধিকারের কথা উচ্চারিত হয়েছিল। তাতেও ভারত নিজের স্বার্থটি খুব বড় করে দেখতে পেয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গে হুগলির পাটকলগুলো কাঁচামালের অভাবে প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান বিদেশে অঢেল পাট রপ্তানী করে এবং তাকে বিদেশ থেকে প্রচুর কয়লা আমদানী করতে হয়। ভারতের কয়লার বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাট আমদানী করতে পারলে চটকল শিল্পের মতো ভারতের একটি বুনিয়াদি শিল্পের সংকটের সহজ সমাধান হয়ে যায়। ইত্যকার বিষয় বিবেচনা করে শুরু থেকেই ভারতের শাসক কংগ্রেস আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্র্তি একটি অনুকুল মনোভাব তৈরি করে রেখেছিল। ছয়দফা আন্দোলন যখন ধাপেধাপে বেগ ও আবেগ সঞ্চয় করে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তার প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি উৎক্রান্তিতে আওয়ামী লীগ যে কৌশল এবং প্রচারপদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, ভারতের শাসক কংগ্রেস পত্রপত্রিকা এবং প্রচার মাধ্যমগুলোতে যে ঢালাও প্রচার করেছিল, তা ভারতীয় জনগণের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আন্দোলনের প্রতি একটি স্বত:স্ফূর্ত অনুরাগ জন্মলাভ করতে সহায়ক হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ কখনো সুভাষচন্দ্র বসুর মতো তেজোদ্দীপ্ত অনাপোষী ভঙ্গীতে বক্তব্য হাযির করেছেন, কখনো চিত্তরঞ্জন দাশের মতো উদার বাঙালীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আবার কখনো বা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মতো সমাজতন্ত্র ঘেঁষা উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণার প্রবক্তা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছয়দফা আন্দোলনের শেষ পর্বে অহিংস অসহযোগ কর্মসূচী ঘোষণার পরবর্তী পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় জনগণের দৃষ্টিতে মহাত্মা গান্ধীর মানসপুত্র হিসেবে দেখা দিলেন।

অহিংসা ছিল মহাত্মা গান্ধীর জীবনাদর্শ। সর্বকাজে সর্বচিন্তায় নিজেকে হিংসামুক্ত রাখাই হলো গান্ধী-দর্শনের মূলকথা। চৌরিচৌরার সংঘর্ষে মাত্র ক’জন পুলিশ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে জেনে মহাত্মা গান্ধী সমগ্র ভারতের জাতীয় আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছিলেন। তার জন্যে তাকে কম জবাবদিহি করতে হয়নি। তথাপি তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়েননি। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মহাত্মা গান্ধীর মতো অহিংসামন্ত্রে বিশ্বাসী বলার কোনো উপায় নেই। তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা থেকে পরিণতি পর্যন্ত সন্ধান করলে এমন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, তিনি অহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। সুতরাং তিনি অহিংস আন্দোলনকে শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক ট্যাকটিকস হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন।

আর বাংলাদেশ আন্দোলন সত্যিকার অহিংস ছিল না। বিস্তর হিংসাত্মক কার্যকলাপ সংগঠিত হয়েছে। জ্বালানো, পোড়ানো, লুঠতরাজ এবং খুন-জখমের অনুষ্ঠানও হয়েছে বিস্তর। আওয়ামী লীগ হাই-কম্যান্ড এসবের বিরুদ্ধে মৌখিক বক্তব্য রাখলেও থামানোর জন্যে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তার ফলশ্রুতিতে বিহারী এলাকাগুলোতে নানারকম নৃশংস কার্যকলাপের অনুষ্ঠান ঘটে।

এই নৃশংসতা দমনের অছিলা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঁচিশে মার্চের রাতের অন্ধকারে ঢাকা শহরের ঘুমন্ত নগরবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতীয় জনগণের পক্ষে বাংলাদেশী অহিংসা চোখে দেখার উপায় ছিল না। তারা কাগজে দেখেছেন, বেতারে শুনেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন। শেখ মুজিবের মধ্যে ভারতীয় জনগণ একই সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহেরু এবং মহাত্মা গান্ধীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন। তাদের প্রতি ভারতীয় জনগণের যে একটি সুপ্ত শ্রদ্ধাবোধ মনের ভিতরে লুকায়িত ছিল, শাসক কংগ্রেসের প্রচারণায় শেখ মুজিবকে আশ্রয় করেই তা পল্লবিত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের সামনে একেবারে নব্য-দেবতার বেশে দেখা দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান॥”

— আহমদ ছফা / বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা ॥ নির্বাচিত প্রবন্ধ ॥ [ মাওলা ব্রাদার্স — ফেব্রুয়ারি, ২০০২ । পৃ: ১৭৮-১৮২ ]

১০.

“… এই মন্বন্তরের আসল কারণ বন্যা নয়, সাইক্লোন নয়, খরা, জলোচ্ছাস কিংবা আকস্মিক নৈসর্গিক বিপদাপদ এর কোনটাই নয়। এই মন্বন্তর শেখ মুজিবের তস্কর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, আওয়ামী লীগারদের একটানা তিন বছরের নির্মম লুন্ঠন, হৃদয়হীন চৌর্যবৃত্তি, তুলনাবিহীন সম্পদ পাচার্, অপচয়, ধ্বংস এবং অদূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির সমূহ ফলশ্রুতি। বন্যা না হলেও এই মন্বন্তর ঠেকাবার কোন যাদুমন্ত্র শেখ মুজিব সরকারের ছিল না। সাম্প্রতিক বন্যা শুধু আওয়ামী লীগের প্রসিদ্ধ তস্করদের দেশে-বিদেশে জাহির করার মত একটা অছিলা এনে দিয়েছে। তাই শেখ মুজিব মনের সুখে গোঁফে তা দিয়ে দেশবাসীর কাছে সেদিন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললেন, ভাইসব, অনেককিছু দেবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বন্যা এসে আমার সব সাধ, সব সাধনা ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমাকে ভুল বুঝবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। আর বিদেশিদের কাছে পরম নিশ্চিন্তে বলে বেড়াচ্ছেন, আমরা তো দেশ গঠনের কাজ বেশ সুন্দরভাবেই করে আসছিলাম, কিন্তু সর্বনাশা বন্যায়ই আমাদেরকে হালে একটু বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।

এই মন্বন্তর বাংলাদেশের জন্য অবধারিত ছিল। কিছুই একে ঠেকাতে পারত না। তবে বন্যার ফলে যে মন্বন্তর আশ্বিন মাসে স্বরূপ প্রকাশ করেছে, হয়ত আরো দুয়েক মাস সময় নিত। ফাগুনের শেষে চোতে-বোশেখে অবশ্যই দেখা দিত। বাংলাদেশে উনিশশো উনসত্তর সালের জল প্লাবনের সময় প্রাণ এবং সম্পদের যে ক্ষয়-ক্ষতি হযেছে, বর্তমান বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি কি তার চেয়ে ভযাবহ? সেই প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের স্মৃতি এখনো একেবারে মিলিয়ে যায়নি। একটা তুলনামুলক হিসেব কষাও বোধকরি অসম্ভব নয়। উনসত্তরের সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের পর দেশব্যাপী হা-অন্ন হা-অন্ন এমন হাহাকার ওঠেনি, মানুষের লাশ এমনি পথে-ঘাটে পড়ে থাকতে দেখা যায়নি, অর্ধমৃত কঙ্কালসার নয়, উদোম নর-নারীর ক্লান্তিহীন মিছিল শহরের রাজপথে ধুঁকে ধুঁকে মরবার জন্য এমন মরিয়া হয়ে ছুটে আসেনি। জিনিসপত্রের দাম একলাফে আকাশে চড়ে নাগরিক সাধারণের জীবনকে এমন বিপর্যস্ত করে তোলেনি। বন্যার ফলে শেখ মুজিব এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা বলবার মতো একটু কথা পেয়েছে। গ্রাম-গ্রামান্তরে পাঁচ টাকায় মা ছেলে বিক্রি করছে, সরলা কিষাণ বালাও আট আনায় বিকোচ্ছে ইজ্জত। বাবা ছেলেকে ফেলে দিয়ে প্রাণ ধারনের নিষ্ঠুর তাগিদে ছুটে পালাচ্ছে। স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, স্বামী স্ত্রীকে।

এই মন্বন্তর বন্যার কারনে হয়েছে, কি আওয়ামী লীগারদের কারনে হয়েছে, সে কথা আজ ঠান্ডা মাথায় বিচার করে দেখবার মতো মানসিক স্থৈর্য খুব কম মানুষেরই আছে। সমাজের স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদেরও বুদ্ধি-বিবেচনা আজ গুলিয়ে একাকার হয়ে গেছে। চূড়ান্ত হতাশ, অসহায় দৃষ্টিতে তারাও নীরব দর্শকের মত তাকিযে তাকিয়ে দেখছেন।

বাংলাদেশের শহরগুলোতে স্রোতের জলের মত কঙ্কালসার নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধের ঝাঁক এসে ভিড় করছে। কানায় কানায় ভরিয়ে তুলছে সমগ্র শহর। নগরীর বাতাসে মানুষ পঁচা লাশের ঘ্রাণ, নগরীর রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা লাশ, ফাঁকা জায়গাগুলোতে কিলবিল করছে ভুখা-নাঙ্গা মুমূর্ষ মানুষের জটলা। এদের অল্পকদিন আগেও ঘর ছিল, ঘরের মায়া ছিল, সংসার ছিল, সংসারের বাঁধন ছিল, বুকে স্বপ্ন ছিল, ছিল অন্তরে মমতা। সুখে-দু:খে, সম্পদে-বিপদে গ্রাম বাংলার ছোট ছোট কুটিরে স্ত্রী পুত্র পরিজন বেষ্টিত পরিবারগুলোতে প্রাণ-প্রবাহের যে রস, যে মাধুর্য উছলে উঠত সব পেছনে ফেলে এরা শহরের রূঢ় রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ তাদের ঘর নেই — ঘরের মায়া উধাও, সংসার নেই, সঙ্গম নেই, বুকের স্বপ্ন কচি মুকুলের মত কবে ঝরে গেছে। জীবন ধারণের নিষ্ঠুর গ্লানি অবনত মস্তকে বয়ে দোরে দোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাত চাই। ভাত নেই তো ফ্যান দাও। ফ্যান যদিও বা না দেবে অন্য কিছু দাও। ঘর-দোর সমাজ-সংসার সব গেছে — এই কষ্টক্লিষ্ট প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগাদা আমাদেরকে শহরে ছুটিয়ে নিয়ে এসেছে। নগরী নিষ্ঠুর্, নগরী ফলে ফলে হেসে ছলছল স্রোতে বয়ে যায়। আর ভাদ্র মাসে তেজালো রোদে পুঁটি মাছ যেমন মরে, তেমনি করে প্রতিদিন শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে মানুষ অমৃতের পুত্র মানুষ মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়ছে।

শেখ মুজিবের সরকার বলবার মত একটা কথা পেয়েছে। দেশের মানুষ মরছে তার কারণ বন্যা। দেশে মন্বন্তর কালো ছায়া প্রসারিত করেছে তার কারণ বন্যা। জিনিসপত্রের দাম লাফে লাফে চন্দ্রলোকের দিকে ধাবমান — তার কারন বন্যা। বাহবা, বাহবা শেখ মুজিব। বুলন্দ নসীব নিয়ে আপনি অনেকদিন বেঁচে থাকুন ভাগ্যবানের সহায় ভগবান। আল্লাহতায়ালা ঠিক সময়ে আপনার মুখ রক্ষা করার জন্য আকাশ থেকে ধারাস্রোত নামিয়ে দিয়েছে। আপনাকে ভাগ্যবান না বলে কাকে বলব। তিনি আপনার সকল সাধ, সকল আকাঙ্খা রহস্যজনকভাবে পূরণ করেছেন। আপনি বাঙালি জাতির পরম শ্রদ্ধেয় পিতৃদেব। রক্ষীবাহিনী, ঠেঙ্গারেবাহিনী দিয়ে গোটা জাতির সাড়ে সাতকোটি মানুষকে বেয়নেট বুলেটের মুখে দাবিয়ে রেখে তিন বছর একটানা বাবা ডাকিয়ে ছেড়েছেন। তিন বছর গত হবার পূর্বেই আপনার পিতৃস্নেহের স্বরূপ প্রকটিত হল। বাংলাদেশকে আপনি ইতিহাসে নজিরবিহীন একতা মন্বন্তর উপহার দিলেন। আশ্চর্য শক্তিমান পুরুষ আপনি, তুলনাবিহীন আপনার বাকচাতুরী, যাদুময় আপনার কন্ঠধ্বনি। এই বাংলাদেশে যখন আপনার সুশাসনে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে — আর আপনার দলের লোকেরা সেই মৃত, অর্ধমৃত মানুষের হাড়-গোড়, চর্বি-মাংশ সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুদের কাছে বেঁচে দিয়ে অর্জিত সম্পদের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করবার পরিকল্পনা করছে, তখনো আপনি বঙ্গবন্ধু থেকে যান। আপনি বাংলাদেশের মানুষের যদি বন্ধু হন তাহলে তাদের শত্রু বলবো কাকে?

এই প্রাকৃতিক দূর্যোগ বন্যা আর আপনার আওয়ামী লীগ দু’য়ের মধ্যে কে বেশি ভয়ংকর? গ্রাম-বাংলাকে নগ্ন করে গতরের মাংশ কে বেশি খুবলে নিয়েছে? জল-বন্যার ডাকাত আর আওয়ামী লীগের ডাকাত উভয়ের মাঝে কে বেশি হিংস্র? জিজ্ঞেস করুন, জবাব পাবেন; জিজ্ঞেস করুন একফোঁটা দুধের অভাবে মরনের মুখে ঢলে পরা শিশুর কাছে; জিজ্ঞেস করুন গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত আট আনায় ইজ্জত বিকানো সরল কিষাণ বউয়ের কাছে; জিজ্ঞেস করুন অচল কল-কারখানার লোহালক্করের কাছে; জিজ্ঞেস করুন আওয়ামী লীগকে মোটা চাঁদা দেয়া চোরাচালানীদের কাছে; জিজ্ঞেস করুন আপনাদের সঞ্চিত সোনাদানার আমানতদার বিদেশী ব্যাংকের ম্যানেজারদের কাছে; জিজ্ঞেস করুন আপনার মন্ত্রীসভার স্ফীতোদর, স্থূলকায় মন্ত্রীদের কাছে; জিজ্ঞেস করুন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া আওয়ামী লীগের কর্মীদের, আপনার মামা এবং ভাগ্নেদের কাছে; জিজ্ঞেস করুন ছেলে-সন্তান, স্ত্রী-পুত্রের কাছে; অকপটে জিজ্ঞেস করুন; জিজ্ঞেস করুন অর্থনীতি শাস্ত্রের কাছে। স্পষ্ট জবাব পাবেন — এই মন্বন্তর, এই দুর্ভিক্ষ, এই মাৎস্যন্যায় আপনার আওয়ামী লীগের তিন বছরের শাসনকালের অনুপম কীর্তিস্তম্ভ॥”

(গণকন্ঠ / ১৫ই অক্টোবর, ১৯৭৪ইং)

— আহমদ ছফা / প্রবন্ধ সমগ্র — তৃতীয় খন্ড ॥ [ হাওলাদার প্রকাশনী — জুন, ২০১৪ । পৃ: ২৩১-২৩৩ ]

১১.

“… (১৪/০৮/১৯৭৫) উদ্দেশ্যহীনভাবে আমি বলাকা বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওমা কিছু দূর যেতেই দেখি একখানা খোলা জিপে সাঙ্গপাঙ্গসহ শেখ কামাল। একজন দীর্ঘদেহী যুবক কামালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, দেখ কামাল ভাই, আহমদ ছফা যাচ্ছে। কামাল নির্দেশ দিলেন, হারামজাদাকে ধরে নিয়ে আয়। আমি প্রাণভয়ে দৌড়ে নিউ মার্কেটের ভেতর ঢুকে পড়ি। যদি কোনদিন স্মৃতিকথা লিখতে হয়, এই পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিশদ করে বর্ণনা করব॥”

— আহমদ ছফা নূরুল আনোয়ার / ছফামৃত ॥ [ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি — ফেব্রুয়ারি, ২০১০ । পৃ: ১০০ ]

১২.

“… ছফা কাকাকে আহমদ শরীফ সাহেব খুব স্নেহ করতেন এবং সম্মানও করতেন। তাঁর মেধার প্রতি ছিল ডক্টর শরীফের অগাধ, বিশ্বাস। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পদের জন্য আবেদন করেছিলেন। তখন আবেদনপত্রে তিনজনের সুপারিশ লাগত। ডক্টর শরীফের পছন্দের তিনজন সুপারিশকারীর মধ্যে একজনের নাম ছিল আহমদ ছফা। এ ঘটনার পর কাকা নিজেকে মহান ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন। তিনি লিখেছেন :

“আমি যখন কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরলাম এক সন্ধ্যায় ড. শরীফের বাড়িতে খেতে গেলাম। তিনি জানালেন, এবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পদের জন্য দরখাস্ত করতে যাচ্ছেন। প্রতিটি পদের জন্য আলাদা আলাদা দরখাস্ত করতে হয় আমি জানতাম না। যা-হােক, তিনি গোটা দরখাস্তটি বের করে এনে দেখালেন। বিশাল ব্যাপার, বিরাট একটা চ্যাপ্টা ফাইল। তিনি আমাকে জানালেন, তার দরখাস্তের সঙ্গে তিনজন বিশেষ ব্যক্তির মতামত সংযুক্ত করে দিয়েছেন। তার একজন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অন্যজন ড. মুহম্মদ এনামুল হক আর তৃতীয় মানুষটি আমি। আমার অবস্থাটি বুঝে দেখুন। এমএ-এর রেজাল্ট বের হওয়ার আগে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাসরি পিএইচ-ডি করার অধিকার শর্তসাপেক্ষে আদায় করে নিয়েছি। এখন দেখতে পাচ্ছি, আমার ছাত্র জীবন শেষ হওয়ার পূর্বে একজন শিক্ষককে প্রফেসর হওয়ার সুপারিশও আমি করতে পারি।” (ছফা, খ, ৪, পৃ. ২২৩)

অবশ্য ডক্টর শরীফ দরখাস্ত পেশ করলেও তাঁকে প্রফেসর করা হয়নি। কারণ তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের একজন বিরাগভাজন ব্যক্তি ছিলেন। এর পেছনে ডক্টর নীলিমা ইব্রাহিমের একটা বড় ভূমিকা কাজ করেছিল, ছফা কাকার লেখাতে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

… হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কাকার একটা কলমযুদ্ধ ‘মানবজমিনে’ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল আটানব্বই সালের জানুয়ারিতে। হুমায়ুন আজাদ ‘দৈনিক মানবজমিনে’ একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন কবি রাজু আলাউদ্দিন। ওই সাক্ষাৎকারে বাংলা-সাহিত্যের এমন কোন কবি-সাহিত্যিক ছিলেন না যাদেরকে হুমায়ুন আজাদ আক্রমণ করেননি। তিনি রবি ঠাকুরকে বলেছিলেন সাম্প্রদায়িক, নজরুলকে মৌলবাদী, লালন ফকিরকে পাগল, আহমদ ছফাকে শাহবাগের উন্মাদ। এভাবে তিনি নানাজনকে নানা অভিধায় অভিহিত করেছিলেন। ছফা কাকা সাক্ষাৎকারটি পড়ে খুব খেপেছিলেন এবং ‘মানবজমিনে’ প্রতিবাদ করে একটি দীর্ঘ লেখা তিনি লিখেছিলেন। ফলে শুরু হয়েছিল দু’জনের মধ্যে বিরতিহীন কলমযুদ্ধ। তাদের এই কলমযুদ্ধ শালীনতার পর্যায় ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ছফা কাকা কী পরিমাণ খেপেছিলেন তার দুয়েকটি মন্তব্য থেকে বুঝা যায়।

তিনি লিখেছেন, শূয়ােরের বাচ্চার দাঁত গজালে বাপের পাছায় কামড় দিয়ে শক্তি পরীক্ষা করে। আবার বলেছেন, এক কান কাটা রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটে, দু’ কান কাটা রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটে।

অনেকে বুঝতে পেরেছিলেন হুমায়ুন আজাদ পত্রিকার শিরোনাম হওয়ার জন্য এই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন। কিন্তু ছফা কাকা তাকে এভাবে আক্রমণ করে বসবেন সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। হুমায়ুন আজাদকে কথার বাণে জর্জরিত করার কারণে কেউ কেউ খুশি হলেও অনেকে তাঁর ওপর নাখোশ হয়েছিলেন। ছফা কাকার মত মানুষকে এ পর্যায়ে নেমে আসাটাকে অনেকে পছন্দ করেননি। পরে বিষয়টি তিনিও অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং অনুতপ্ত হয়েছিলেন। ফলে তাকে লিখতে হয়েছিল :

“আমি ‘মানবজমিনে’র পাঠক-পাঠিকা ভাইবোনদের কাছে প্রথমে ক্ষমা চাইব। ক্ষমা চাইব একারণে যে, একজন লেখকের কাছে সুরুচিসম্পন্ন পাঠক যে ধরনের শোভন আচরণ প্রত্যাশা করেন, আমার আশঙ্কা হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আমার যে একটি অনি:শেষ বাহাস চলছে, তাতে শালীনতার মাত্রাটি পুরোপুরি রক্ষা করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের কাছে দুই গুণ বেশি ক্ষমা চেয়ে নেবার তাগিদ ভেতর থেকে অনুভব করছি। আমাদের যাদের বয়স হচ্ছে, পরিস্থিতির চাপে অনেক সময় আমাদের উজ্জ্বল অংশ তুলে ধরার বদলে কদর্য অংশ প্রদর্শন করতেই বাধ্য হচ্ছি। আর সে কারণে তরুণ-তরুণীরা আমাদের টিটকারি করেন এবং অনুকম্পা প্রদর্শন করেন। আমি মনে করছি সে জিনিসগুলো ইতােমধ্যে আমাদের প্রাপ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।” (ছফা, খ, ৮, পৃ. ৪০২)

এ লেখাটি লিখে ছফা কাকা হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কলমযুদ্ধের ইতি ঘটিয়েছিলেন। এক সময় হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে তাঁর সুন্দর সম্পর্ক ছিল। একটা সাক্ষাৎকারের কারণে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাকা হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আগের সে সম্পর্কে ফিরে যেতে পারেননি। তবে কাকার লাশ যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের সামনে রাখা হয়েছিল সেখানে হুমায়ুন আজাদকে দেখেছিলাম মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে। তিনি বলেছিলেন, আমার ঝগড়া করার মানুষটিও থাকল না।

কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গেও কাকা একটি বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। ছিয়ানব্বই সালে শামসুর রাহমান ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’য় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন ব্রাত্য রাইসু এবং রাজু আলাউদ্দিন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আহমদ ছফাকে একজন ‘ধান্ধাবাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। শামসুর রাহমান সাহেবের এমন মন্তব্যে ছফা কাকা খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে ছফা কাকার এক সময় খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল। তাদের লেখায় দেখা যায়, তারা এক সময় একসঙ্গে অতি সুন্দর সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। একসঙ্গে চলাফেরা, একসঙ্গে ওঠাবসা, একসঙ্গে আড্ডা দেয়ার মধ্যদিয়ে তাদের দিনগুলো অতিবাহিত হত। ছফা কাকা তো বলতেন আমি এক সময় শামসুর রাহমান এবং তাঁর কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম। তিনি শামসুর রাহমানকে এক সময়কার গুরু হিসেবে অভিহিত করতেন। তিনি এ-ও দাবি করতেন, শামসুর রাহমানের অনেক কবিতা তিনি মুখস্ত বলতেন পারেন। কালক্রমে শামসুর রাহমান রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়লে ছফা কাকার সঙ্গে তার মতের পার্থক্য দেখা দেয়। ফলে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এতে করে শামসুর রাহমানের প্রতি কাকার একটা সুপ্ত অভিমান কাজ করত, যে কারণে তিনি শামসুর রাহমানের রাজনীতি এবং কবিতার মান নিয়ে নানাভাবে সমালোচনা করতে পিছ পা হতেন না। তবে সেটা শালীনতা ছাড়িয়ে যেত না। শামসুর রাহমান যখন তাকে ‘ধান্ধাবাজ’ বললেন তখন ছফা কাকা তার পুরনো অনেক ঘটনার অবতারণা করে পত্রিকায় একটি লেখা লিখে বসলেন, যেটি তাকে মারাত্মকভাবে আহত করে। লেখাটির একটি অংশ :

“কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মারা যাওয়ার পরে আমরা লিচুতলায় একটি শোকসভার আয়োজন করি এবং তাতে শামসুর রাহমান এবং তার বলয়ের কতিপয় ব্যক্তির কঠোর নিন্দা করি। কারণটা বুঝিয়ে বলি। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন অকালে প্রাণ হারাল, ক্ষিপ্ত তরুণ কবিদের অনেকেই প্রকারান্তরে কবি শামসুর রাহমান এবং তাঁর মত মানুষদের রুদ্রের মৃত্যুর জন্যে আংশিক দায়ী করলেন। যাঁরা দাবিটি উত্থাপন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অসীম সাহাও একজন ছিলেন। শামসুর রাহমান সাহেব কবিতা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। স্বৈরাচারী এরশাদ যখন এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করছিলেন তার প্রতিবাদে জাতীয় কবিতা উৎসবটি করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই কবিতা পরিষদের পেছনে রুদ্র অনেক সময় ব্যয় করেছিলেন এবং কবিতা পরিষদের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। এক সময় শামসুর রাহমান এবং তাঁর চ্যালারা রুদ্রকে ওই কবিতা পরিষদ থেকে তাড়িয়ে দেন। তারপরে রুদ্র সঙ্গীত পরিষদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে উঠে পড়ে লেগে যায়। বেদনার কথা হল, সেখান থেকেও রুদ্র বিতাড়িত হয়। অনেকেই মনে করেন এই মানসিক আঘাতগুলো রুদ্রের মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছে। এর পেছনে হয়ত সত্য নেই, তথাপি তরুণ মনের কাউকে না কাউকে দায়ী করার প্রবণতার ব্যাপারটি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। হয়ত শামসুর রাহমান সাহেবরা দায়ী ছিলেন না, কিন্তু রুদ্রের প্রতি অবিচার করেছিলেন। আমি সেটা এক শ’ ভাগ মনে করি। সেজন্যে সভা করে আমি শামসুর রাহমান এবং অন্যদের নিন্দা করেছিলাম।” (ছফা, খ, ৫ পৃ. ৩৪৮)

তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন তার পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা হয়েছে। কোলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী ‘লজ্জা’ নিয়ে এত মাতামাতি করেছিল যে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে অনেকটা খাটাে করে ফেলেছিল। কবি শামসুর রাহমান এবং তার বলয়ের মানুষেরা আনন্দবাজারের সঙ্গে একজোট হয়ে তসলিমাকে সমর্থন জুগিয়েছিলেন। ফলে শামসুর রাহমানদের ওপর ছফা কাকা খেপেছিলেন। তিনি লিখেছেন :

“দ্বিতীয়বার তার প্রতি নিন্দা জানানোর জন্য আর একটি সভার উদ্যোগ আমি নিয়েছিলাম। লোকজন বিশেষ পাওয়া যায়নি বলে পরিকল্পনাটা বাদ দিতে হয়। আমি শামসুর রাহমান সাহেবকে নিন্দা করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম একটি বিশেষ কারণে। কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী তসলিমার ‘লজ্জা’ পুস্তককে উপলক্ষ করে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে খাটাে করার যে কাল্পনিক চেষ্টায় মেতে উঠেছিল শামসুর রাহমান এবং তার মত মানুষেরা সেটা সমর্থন করেছিলেন। শামসুর রাহমান সাহেবরা ঠিক করেছিলেন কিনা সেটা সকলের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম। মাঝখানে তসলিমা সংবাদপত্রে যে বিবৃতিটি দিয়েছেন তার সংবাদপত্র শিরোনাম ছিল, ‘Indians have destroyed me’ অর্থাৎ ভারত আমার সর্বনাশ করেছে। তসলিমা তাঁর বিবৃতিতে আরও বলেছেন, ভারতীয়রা উস্কানী দিয়ে আমাকে ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিয়েছে।

শুরুর দিকে ভারত সারা পৃথিবীতে তসলিমার বিষয়টি তুলে ধরলেও পরে তাঁরা তসলিমাকে ভারতে আসার ভিসা দিতে অস্বীকার করেছে। তসলিমা বেচারি ‘আনন্দবাজারের’ কাছ থেকে প্রাপ্য বিপুল পরিমাণ টাকাও আদায় করতে পারেনি। এখন শামসুর রাহমান সাহেব নিজেও তসলিমার নিন্দা করছেন।” (ছফা, খ, ৫ পৃ. ৩৫০)

কবি শামসুর রাহমান আওয়ামী লীগের শাসনামলে এমনভাবে সরব হয়ে উঠেছিলেন যে প্রায় প্রতিদিনই তাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যেত। তখন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বলতে গেলে তিনিই নিয়ন্ত্রণ করতেন। হয়ত শাসক মহল তাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। শামসুর রহমান সাহেবের যেখানে সেখানে এমন উপস্থিতি ছফা কাকা পছন্দ করতে পারতেন না। ফলে তিনি শামসুর রাহমানকে “রাজকবি’ হিসেবে সম্বোধন করতেন। তিনি তাঁর প্রতি এত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এরকম কথাও তিনি লিখেছিলেন :

“আমার খুব সাধ জাগে, হাতে যদি টাকা-পয়সা আসে আমার এককালীন গুরুকে একখানি চকচকে আয়না কিনে দেব, যাতে নিজের চেহারাটি তিনি ভালমত অবলোকন করতে পারেন।” (ছফা, খ, ৫, পৃ. ৩৫০)

শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকারের বিপরীতে ছফা কাকা যখন পত্রিকায় লেখাটি লিখেছিলেন, শামসুর রাহমানও ওইদিন তাঁর প্রতিক্রিয়া পত্রিকায় জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন :

“এটা সাক্ষাৎকারের অংশ ছিল না। তবু এটিকে কেন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা প্রকাশ করলেন, আমি বুঝতে অক্ষম। আহমদ ছফার সঙ্গে আমার মতের অমিল থাকতে পারে, কিন্তু সেজন্য উদ্যোগী হয়ে বিবাদ করার মত সময়, মানসিকতা ও বয়স কোনটাই এখন আমার নেই।

তাছাড়া ছফার লেখা সম্পর্কে এক জায়গায় আমার মন্তব্য থেকেই বোঝা যাবে, আমি সিরিয়াসলি এ ধরনের নির্দয় মন্তব্য করতে পারি না।

… সবশেষে বলি, অনভিপ্রেত এবং অনিচ্ছাকৃত এই মন্তব্যের জন্যে আমি দুঃখিত। লেখক আহমদ ছফা আমার অত্যন্ত গ্ৰীতিভাজন। তাকে আঘাত করার বাসনা কখনও আমার ছিল না। তিনি আমার স্বীকারোক্তির পরে সেটা অবশ্যই অনুধাবন করতে পারবেন।” (ছফা, খ, ৫, পৃ. ৩৫১)

আমার ধারণা, কবি শামসুর রাহমান ইচ্ছাকৃতভাবে এ মন্তব্য করেননি। অনেক আগের তার একটি লেখা পড়লে বোঝা যায় তিনি ছফা কাকাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। তাঁর লেখাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনি বড় মাপের উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ওই লেখার একটি খণ্ডিত অংশ এখানে তুলে ধরছি:

“আহমদ ছফা বলা নেই, কওয়া নেই, গোড়াতেই আমাকে আক্রমণ করে বসলেন। তাঁর বাক্যবাণে জর্জরিত আমি কোন জবাব খুঁজে পেলাম না। তাঁর কথা শুনে আমার খারাপ লাগার কথা, কিন্তু কী আশ্চর্য, তাকে আমার ভাল লাগল। ইনি পিছন থেকে ঠোকর মারেন না, মুখোমুখি বসেই হামলা করেন। অনেকের অভ্যাস হল পিছন থেকে কামড়ানাে। তিনি সেই অভ্যাস থেকে মুক্ত ছিলেন বলেই তাঁকে আমার ভাল লেগেছিল। যা বলার তা তিনি মুখের উপরেই বলতে পারেন নির্দ্বিধায়। এ ধরনের আচরণ অধিকাংশ ব্যক্তির পক্ষে বরদাশত করা মুশকিল। আমার ভাল লাগে তাঁর মতামতের সততার জন্য। আমাদের লেখক সমাজে বৌদ্ধিক অসাধুতা এতই প্রকট যে এর মধ্যে কারও কারও বৌদ্ধিক সততা, তারা ঠোঁটকােটা হওয়া সত্ত্বেও প্রশংসনীয় ও শ্রদ্ধেয়।” (ছফা, স্মা, পৃ. ১৬)

কবি শামসুর রাহমানের মত কবি আল মাহমুদও ছফা কাকার একজন শুভাকাঙ্খী ছিলেন এবং একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। আল মাহমুদকে আহমদ ছফা ‘কাকা’ বলে সম্বোধন করতেন। এক সময় তাঁরা একই মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং একই রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণ করতেন। পচানব্বই সালে আল মাহমুদ ও “বাংলাবাজার পত্রিকা”য় একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এতে তিনি নিজেকে একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা লেখক হিসেবে দাবি করেছিলেন। তাঁর এই দাবিকে ছফা কাকা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। ওই সময় এমনিতেই তিনি শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদকে মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি মনে করতেন, একজন রাজনীতির লাঠি এবং আরেকজন ধর্মের লাঠি নিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে যুদ্ধ করতে নেমেছেন। এমতাবস্থায় আল মাহমুদের সাক্ষাৎকারটি তাকে নিয়ে লেখার পথটি প্রশস্ত করে দিল। তবে এ লেখায় তিনি শালীনতা বজায় রেখেছিলেন। লিখেছেন :

“আল মাহমুদের সাথে আমার একটি সুসম্পর্ক রয়েছে এবং আমি তাঁর কবিতার একজন অনুরাগী পাঠকও। এক সাথে একই প্লাটফর্ম থেকে রাজনীতিও আমরা করেছি। আল মাহমুদ যে রকম উত্তেজিতভাবে নিজেকে একমেবাদ্বিতীয়ম প্রমাণ করতে চেয়েছেন — এই মনোভঙ্গিটির মধ্যে কি একটা মানসিক ভারসাম্যহীনতা নেই? অথবা এমনও হতে পারে তিনি একটা কোণঠাসা অবস্থান থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশে এই কথাগুলো এমনভাবে বলেছেন।

যা-হােক, আল মাহমুদ তাঁর নিজের কথা বলেছেন। কারও ভাল লাগতে পারে, কারও মন্দ লাগতে পারে। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এগুলো আল মাহমুদের মতামত। আমি শুধু একটি ছোট্ট বিষয়ে প্রতিবাদ নয় চ্যালেঞ্জ করতে চাই। তিনি মুক্তিযোদ্ধা লেখক এবং মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র লেখক হিসেবে নিজেকে দাবি করেছেন। কথাটা যদি তিনি উত্তেজনার বশে বলে থাকেন তাহলে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, তিনি ছাড়া আরও অনেক লেখক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং লিখেছেন। প্রতিভা এবং ক্ষমতা সবার সমান নয়। তবে কমিটমেন্ট তথা অঙ্গীকার হল আসল কথা। অন্যকোন লেখক মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কমিটেড ছিলেন না — এটা আল মাহমুদের বলা উচিত হয়নি। আমি আশা করছি, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে তিনি নিজেও তাঁর এই ভুলটি স্বীকার করে নেবেন। আমার বলতে দ্বিধা এবং সংকোচ হচ্ছে, তথাপি সত্যের খাতিরে কথাটা বলা উচিত, আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এবং লিখেছি। সে সময়ে সে লেখাগুলো মানুষ পছন্দও করেছিল। যেহেতু আমরা আল মাহমুদের মত দৃঢ়চিত্ত এবং মনোবলসম্পন্ন লেখক নই, সেজন্য ঘোষণা দিতে পারিনি। মেনে নিলাম আল মাহমুদ বড় লেখক এবং আমরা নিতান্ত তুচ্ছ লেখক। কিন্তু একজন বড় লেখকের একটি বড় গুণ হল এই যে তুচ্ছ লোকের তুচ্ছতা এবং অকিঞ্চিৎকরতার মধ্যেও কিছু যে মূল্য থাকে সেটা তারা চিনে নিতে পারেন। এখন আমার যেটা ভাবনার বিষয়হয়ে দাঁড়িয়েছে … আল মাহমুদ অন্য সবাইকে তুচ্ছ করে নিজেকে কোন উচ্চতায় স্থাপন করলেন?” (ছফা, খ, ৭, পৃ. ৩৬২)

আল মাহমুদের কথা এখানে থাক। হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপারে দু’ চারটি কথা না বললে এই লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কারণ হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ছফা কাকার একটা অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কেবল হুমায়ূন আহমেদের কথা বললে হবে না, সেই সঙ্গে আনিস সাবেত নামের একজনের কথাও এখানে আসতে বাধ্য। নানাজনের লেখা পড়ে বুঝতে বাকি নেই যে, এই তিন ব্যক্তিত্ব এককালে একসঙ্গে খুব সুন্দর সময় পার করেছিলেন। আমার মনে হয়েছে, এরা তিনজন তরুণ বয়সে একে অপরের সুখ-দুঃখের ভাগীদার ছিলেন।

অনেকে মনে করেন, হুমায়ূন আহমেদের আজকে যে উত্থান ঘটেছে সেটির বীজটি রোপণ করেছিলেন ছফা কাকা। শুনতে পাই, উনিশ শ’ বাহাত্তর সালে হুমায়ূন আহমেদ তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ লিখেন। ছফা কাকা বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন। তখন কোন প্রকাশকই তাঁর লেখাটি ছাপার যোগ্য মনে করেননি, এমনকি নতুন লেখক বলে হুমায়ূন আহমেদকে কেউ পাত্তাও দিতে চাননি। মুক্তধারার মত আরও অনেক বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এ উপন্যাসের সাহিত্যমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে এধরনের একটা লেখা কেন ছাপতে হবে। বর্তমানে যারা সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষণ করেন ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাদের অনেকে ছিলেন। তারাই সাহিত্য হয়েছে কিনা তার সার্টিফিকেট দিতেন। ‘নন্দিত নরকে’ বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে ছফা কাকা এটি নিয়ে খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বইটি প্রকাশ করার জন্য প্রকাশককে বাধ্য করেছিলেন। তিনি কেবল একজন প্রকাশক যোগাড় করে দিয়ে দায় সারেননি, বইটির প্রচার প্রসারের দায়িত্বও অনেকটা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ডক্টর আহমদ শরীফ এই বইটির জন্য একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন কাকার অনুরোধে। কাকাও বইটির একটা আলোচনা পত্রিকায় লিখেছিলেন বলে জানতে পারি।

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের সংখ্যা বর্তমানে কত আমার জানা নেই। হয়ত কয়েক শ’ হবে। এখনও পর্যন্ত ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটিকে অনেকে শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে দাবি করেন। ছফা কাকাকে তার পছন্দের বইয়ের নাম বলতে বললে ‘নন্দিত নরকে’র কথা তিনি তার তালিকায় রাখতেন। পরে অবশ্য ‘এপিটাফ’ বলে একটা বইয়ের গুণগান তিনি করেছিলেন। হুমায়ুন আহমেদের প্রতি ছফা কাকার যে উচ্ছাস ছিল সেটি পরবর্তীতে হ্রাস পেয়েছিল। কেউ হুমায়ুনের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি খেপে যেতেন। এক সাক্ষাৎকারে কাকাকে হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয়তার কারণ কী জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন :

“হুমায়ুনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ইতিহাস যারা জানেন, তাদের অনেকেই তার এই উন্নতি বা অবনতির জন্য অংশত আমাকেই দায়ী করতে চান। তাঁর প্রথম বই যখন বেরিয়েছিল, আমিই সবচাইতে বেশি উচ্ছাস প্রকাশ করেছি। তখন আমার মনে হয়েছিল হয়ত হুমায়ুনের মধ্যে কালে কালে আমরা চেখভের মত একজন প্রতিভার সন্ধান পাব। তিনি তো সে পথে গেলেন না। উপর্যুপরি সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক আকাজক্ষার পরাজয় সব মিলিয়ে এখানে যে চিন্তাহীন অরাজক পরিস্থিতি — হুমায়ুন সেই সময়ের প্রোডাক্ট। অবশ্য হুমায়ুনের ব্যক্তিগত কামালিয়াত এটুকু যে তিনি পাঠকদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন। আমার প্রশ্ন, এটা কি স্থান? হুমায়ুনের পরবর্তী সময়ের রচনা চানাচুরের মত। খেতে মজা লাগে, কিন্তু পেট ভরে না এবং সার পদাৰ্থও বিশেষ নেই।” (ছফা, স্মা, পৃ. ৬০)

হুমায়ূন আহমেদ, আনিস সাবেত এবং ছফা কাকা সম্পর্কে একটা গল্প প্রচলিত আছে। তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন জীবনে বিয়ে করবেন না। একথাটা হুমায়ূন আহমেদ নাকি তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বয়ান করেছেন। কিন্তু ছফা কাকা হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে একমত ছিলেন না। আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার সমগ্রে’ দেখতে পাই : “হুমায়ুন কথাটা কিভাবে বলেছে জানি না। তবে সে অনেক সময় অনেক কথা কল্পনা করে বলে। বলতে ভাল লাগে, এ জন্য বলে। (ছফা, সা, পৃ. ১০২)

হুমায়ূন আহমেদের এক লেখা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতাত্তর সময়ে তাঁরা বাবর রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকতেন। এক রাতে রক্ষীবাহিনী তাদেরকে ওই বাসা থেকে বের করে দেয়। ওই রাতে পরিবারের সকলে রাস্তায় নির্ঘুম কাটিয়েছিলেন। খবরটা ছফা কাকা কোন না কোনভাবে পেয়েছিলেন এবং সকাল হতে না হতেই ঘটনাস্থলে পৌছে গিয়েছিলেন। তার হাতে ছিল একটি কেরোসিনের টিন। উদ্দেশ্য গণভবনে গিয়ে তিনি নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মাহুতি দেবেন। তখন তিনি একটি শহীদ পরিবারের অপমানের যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। সিকান্দার আবু জাফর ছুটে এসে ছাফা কাকাকে থামিয়েছিলেন এবং হুমায়ূন আহমেদ মা-ভাই বােন নিয়ে পুনরায় একই বাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন।

আরও একটা ঘটনার কথা হুমায়ূন আহমেদ বয়ান করেছেন। তাঁরা আনিস সাবেতের বােনের বিয়েতে কুমিল্লা গিয়েছিলেন। সেখানে আনিস সাবেত ছফা কাকার কোন একটি লেখার সমালোচনা করলে তিনি ভীষণ রকম খেপে যান। আনিস সাবেত তার মতে অটল থাকার কারণে ছফা কাকা রাতের বেলা ওঁদের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। তখন রাত এত দূর গড়িয়েছিল যে রাস্তায় কোন গাড়ি ছিল না। ফলে ছফা কাকা কুমিল্লা থেকে হেঁটে ঢাকা চলে এসেছিলেন। তাতে ছফা কাকার পা ফুলে গিয়েছিল। তাঁর জ্বর এসে গিয়েছিল। পরদিন আনিস সাবেত ছফা কাকার কাছে ক্ষমা চাইতে গেলে তিনি বলেছিলেন, সারা রাস্তা হেঁটে আসার কারণে তার মাথায় একটি উপন্যাসের ধারণা মাথায় এসে গিয়েছে। রাগ করে না এলে এ ধারণাটা আসত না। হুমায়ূন আহমেদের কথা — যে উপন্যাসের গল্পটি তাঁর মাথায় এসেছিল তার নাম “ওঙ্কার’।

আমি হুমায়ূন আহমেদের কথার দ্বিমত করব না। আমিও একটি ঘটনার কথা জানি। ‘ওঙ্কার’ যখন চিত্রায়ন হয় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে সাংবাদিকেরা ছফা কাকাকে ঘিরে ধরেছিলেন কোন প্রেক্ষাপটে এমন একটি উপন্যাস তিনি লিখেছেন সেটি জানার জন্য। আমার স্পষ্ট মনে আসছে না, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কিংবা অন্যকোন বন্ধুর বাড়িতে হবে। ওই বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে তিনি দেখেন যে তাদের এক বছরের ছােট্ট মেয়েটি কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। ব্যাপারটি ছফা কাকাকে ভীষণভাবে ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল এবং সেই ভাবনা থেকে তিনি ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসটি লিখতে কলম ধরেছিলেন।

হুমায়ূন আহমেদ কাকা সম্পর্কে অনেক জানেন আমি স্বীকার করি এবং এটাই স্বাভাবিক। তিনি তাঁর আত্মজীবনী মূলক লেখা ‘বলপয়েন্টে’ কাকা সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। আমার ধারণা তিনি স্মৃতি থেকে লেখার কারণে কাকা সম্পর্কে কিছু ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন। ‘বলপয়েন্ট’ যখন ‘সাপ্তাহিক ২০০০”-এ ধারাবাহিকভাবে ছাপাচ্ছিল আমি তাঁর দেয়া কিছু তথ্যের প্রতিবাদ করেছিলাম। আমার প্রতিবাদটি হুমায়ূন আহমেদের দৃষ্টিগােচর হয়েছিল। তিনি বই আকারে ছাপার সময় ভ্রান্তিগুলো শুধরে নেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। লেখক মাত্ৰই ভাবুক মানুষ। সুতরাং সব কথা মনে রাখা অনেক লেখকের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের সঙ্গে কাকার একটা সুসম্পর্ক ছিল। তিনি মারা যাবার আগেও হুমায়ূন আহমেদের মা-বােনকে আমি কাকার সঙ্গে দেখা করতে আসতে দেখেছি। তারা পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করতেন। হুমায়ূন আহমেদের অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গেও ছফা কাকার একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল। মুহম্মদ জাফর ইকবালও সেটা অস্বীকার করেননি। তাঁর লেখায় দেখতে পাই :

ঠিক কী কারণে জানি না ছফা ভাই আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। আমার সঙ্গে দেখা হলেই তিনি আমাকে নানা জায়গায় নিয়ে যেতেন। তাঁর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করার আমার একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তার কথা বলার ঢংটা আমার কাছে অসম্ভব চিত্তাকর্ষক মনে হত। পৃথিবীর সবকিছু নিয়ে কৌতুক না হয় বিদ্রুপ করতে পারতেন। সহজ একটা জিনিস নিয়ে এমন বিচিত্ৰ উপমা টেনে আনতেন যে আমি হাঁ করে তার কথা শুনতাম। দেশের সকল বড় বড় কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী এবং বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। তাদের সঙ্গে দেখা করে তিনি তার নিজের ঢঙে কথা বলতেন, না হয় ঝগড়াঝাঁটি করতেন। সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজনীতি বা রাজনীতির মত বড় বড় ব্যাপার নিয়ে তখন আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না — আমি ছফা ভাইকে দেখে মুগ্ধ।” (ছফা, স্মা, পৃ. ১২৪)

হুমায়ূন এবং মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে লিখলে কথা জমা হবে। সব কথা তো আর টেনে আনা সম্ভব নয়। এ পরিবারের প্রসঙ্গটি এখানেই ইস্তফা দিলাম।

কাকার কাছের মানুষ হিসেবে আরেকজনের নাম উল্লেখ করতে হয়, তিনি হলেন কবি ফরহাদ মজহার। ফরহাদ মজহার কাকার অনেক ভাল কাজের সঙ্গী ছিলেন। ছফা কাকার জীবনী যদি লিখতে হয় ফরহাদ মজহারকে বাদ দিলে সেটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। জীবনের অনেক উৎকৃষ্ট সময় তাঁরা এক সঙ্গে কাটিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য-সংগঠন করে। বাংলা মটরের বাসায় আমি ছফা কাকার সঙ্গে থাকতাম, তখন দেখতাম কাকা খুব ভোরে ফরহাদ মজহারকে ফোন করতেন। তখনও হয়ত তাঁর ঘুম ভাঙেনি। জেগে থাকলে তিনি ফোন ধরতেন, নইলে ফরিদা আখতার।ফরহাদ মজহারকে সম্বোধন করতেন ‘হযরত’, আর ফরিদা আখতারকে বলতেন ডক্টর ফরিদা। ফরিদা আখতার মাঝে মাঝে আপত্তি করতেন ‘ডক্টর’ বলার জন্য। তখন ছফা কাকা বলতেন, আমার কাছে এক ডজন ডক্টরেট ডিগ্রি আছে। সব দিয়েটিয়ে কয়েকটা বাকি আছে। আপনাকে একটা দিলাম।

ছফা কাকার যারা কাছের মানুষ ছিলেন তাদের তিনি নানা নামে সম্বোধন করতেন। ফরহাদ মজহারকে ‘হযরতঽ’ফরিদা আখতারকে ‘ডক্টর’, ডক্টর হোসেন জিল্লুর রহমানকে ‘লিডার’, চট্টগ্রামের নিপ্পন একাডেমির প্রধান নুরুল ইসলামকে বলতেন ‘বদ্দা’, ডক্টর সরদার আবদুস সাত্তারকে ‘বাবা’, দর্শন বিভাগের প্রফেসর ডক্টর আনিসুজ্জামানকেও ‘বাবা’ সম্বোধন করতেন। ডক্টর মফিজ চৌধুরীকে তো আগে থেকেই বাবা ডাকতেন। কবি আল মাহমুদকে ‘কাকা’, কবি আসাদ চৌধুরীকে ‘কালাচান’, কবি ব্রাত্য রাইসুকে বলতেন ‘রাইসু মণ্ডলী’ অথবা ‘রাইসু কোম্পানি ইত্যাদি নামে।

বলছিলাম কবি ফরহাদ মজহারের কথা। সারা রাত ছফা কাকার মাথায় যত কথা জমা হত ভোর হলেই তিনি ফরহাদ মজহারকে শোনাতেন। তাদের মধ্যে এ ফোনালাপ দীর্ঘ সময় ধরে চলত। কোন কোনদিন সন্ধ্যার সময় ফরহাদ মজহার ছুটে আসতেন। সঙ্গে থাকতেন ফরিদা আখতার। দুজনের মধ্যে খুব তর্কবিতর্ক হত। কখনও শীতল, কখনও উত্তপ্ত। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন এমন অবস্থাও হত।

ফরহাদ মজহার কাকার খুব কাছের বন্ধু। তাদের মনের কথা একে অপরকে ভাগ করতে না পারলে দুজনের পেটের ভাত হজম হত না। তবে তাদের বন্ধুত্ব সব সময় টিকেছিল সেই কথা আমি বলব না। তাদের দুজনের মধ্যে মান-অভিমান খুব কাজ করত। মাঝে মাঝে দেখা যেত তাদের যাওয়া-আসা, ফোনালাপ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কিভাবে কিভাবে তাদের সম্পর্ক প্রতিস্থাপনাও হত। সেই ভাঙ্গন ধরা সম্পর্ক যে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিত তা-ও কিন্তু নয়।

ছফা কাকা যখন ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ লিখেন ওই সময় ফরহাদ মজহারের সঙ্গে তার সম্পর্কটা অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। তখন শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায়। ছফা কাকা পত্রপত্রিকায় শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করে অনেক কলাম লিখেছিলেন, যেগুলো কিছুটা বিএনপির পক্ষে কাজ করছিল বলে অনুমেয়। তিনি বিএনপিকে ভালবেসে লিখেছিলেন তা কিন্তু নয়। সত্য কথা কোন না কোন পক্ষে যেতে বাধ্য। সঙ্গত কারণে তখন সেটা হয়ত হয়ে গিয়েছিল। এজন্য ছফা কাকাকে অনেকে দোষারোপ করতে পিছ পা হননি। আমার ধারণা, কবি ফরহাদ মজহারও তাদের একজন ছিলেন।

‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ যখন বাজারে আসে ছফা কাকা একটা কপি ফরহাদকে খোচা দিয়ে কাকা কিছু কথা লিখে দিয়েছিলেন, যেগুলো কবি ফরহাদ মজহারকে আহত করে। কথাগুলো কী লিখেছিলেন এ মুহুর্তে আমার মনে নেই। ফরহাদ মজহার কাকার লেখা পড়ে বিদ্যুতের শক খাওয়া পাখির মত ফেটে পড়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বইটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি কাকাকে খুব কঠিন ভাষায় কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ছফা বিএনপির দালাল হয়ে গেছে। আমি বইটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছিলাম। বাড়িতে এসে কাকাকে পুরো ঘটনাটা বয়ান করলে তিনি হেসে বললেন, ছেড়ে দাও।

তার কিছুদিন পর দেখলাম ফরহাদ মজহারকে ছফা কাকার বাসায় নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে, যেন তাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। কী অদ্ভুত সম্পর্ক! ছফা কাকা আজ বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে কী বলতেন জানি না — কবি ফরহাদ মজহার খালেদা জিয়ার সঙ্গে চীন সফর করেছেন। তিনি ওই দলের নানা সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করছেন। বন্ধু বলেই তো কথা ! তাই ছফা কাকা জবাবটা হয়ত এভাবেই দিতেন, বন্ধু, আমি কিছুই দেখিনি॥”

— নূরুল আনোয়ার / ছফামৃত ॥ [ খান ব্রাদার্স — ফেব্রুয়ারি, ২০১০ । পৃ: ৯০ ।১৫৫-১৬৪ ]

পুরো লেখাটা ফেসবুকে লিখেছেনঃ Kai Kaus

--

--

Mohammad Anisul Islam

Software Engineer || Full Stack Developer || Technical Writer || Speaker